বাংলাদেশে পেপ্যাল কেন নেই? প্রত্যাশা ও সম্ভাবনা
অনলাইন লেনদেন সেবার অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে যাত্রা শুরু করা পেপ্যাল, বিশ্বের ২০০ টিরও বেশি দেশে আর্থিক লেনদেনকে সহজতর করে তুলেছে। ১৯৯৮ সালে পেপ্যালের যাত্রা শুরু হওয়ার পর দ্রুতই এটি ই-কমার্স এবং ফ্রিল্যান্সিং খাতে প্রধান পেমেন্ট মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ, সারা বিশ্বে লাখ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের লেনদেনের জন্য নির্ভর করছে পেপ্যালের উপর। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও পেপ্যালের প্রবেশ সম্ভব হয়নি।
পেপ্যাল ব্যবহারের সুবিধা
অনলাইনে লেনদেনের ক্ষেত্রে পেপ্যালের সেবা বেশিরভাগ সময়ে অন্যান্য পেমেন্ট মাধ্যমের তুলনায় দ্রুত, সহজ ও নিরাপদ। এর মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী কেবল একটি ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করেই লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। ব্যাংক বা কার্ডের তথ্য প্রতিবার দিতে হয় না, যা লেনদেনকে নিরাপদ এবং ঝামেলামুক্ত করে তোলে। শুধু তা-ই নয়, পেপ্যালের মাধ্যমে একজন ব্যবহারকারী দেশের সীমানা পেরিয়ে যেকোনো স্থানে টাকা পাঠাতে বা গ্রহণ করতে পারেন। ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং—সব ধরনের ডিজিটাল সেবায় এটি জনপ্রিয়।
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে পেপ্যাল
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ফ্রিল্যান্সিং বাজার হিসেবে বিবেচিত। দেশের প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার বিদেশি ক্লায়েন্টদের জন্য কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সরকারিভাবে প্রচারিত "ঘরে বসে আয়" স্লোগানের পেছনেও রয়েছে এই ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিশাল সুযোগ। কিন্তু, ফ্রিল্যান্সারদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আন্তর্জাতিক লেনদেনের জটিলতা। পেপালের অনুপস্থিতি অনেক ফ্রিল্যান্সারকে বিকল্প মাধ্যম ব্যবহার করতে বাধ্য করছে, যা প্রায়ই বেশি সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
পেপ্যাল থাকলে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা সহজে এবং দ্রুত তাদের উপার্জিত অর্থ দেশে আনতে পারতেন। এছাড়া, ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে পেপ্যালের মাধ্যমে লেনদেনের স্বীকৃতি রয়েছে, যা ফ্রিল্যান্সারদের ক্লায়েন্টদের সাথে অর্থ লেনদেনকে আরও সহজতর করত। বাংলাদেশে পেপ্যালের উপস্থিতি থাকলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ত।
ই-কমার্স খাতে পেপ্যাল
বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতও গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। ই-কমার্স ব্যবসাগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেনের সুযোগ আরও বড় একটি বাজার খুলে দিতে পারে। পেপ্যাল থাকলে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য ও সেবা সহজেই বিদেশি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে ই-কমার্স সাইটগুলো পেপ্যাল ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করে থাকে। বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তারাও এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে পেপ্যালের অনুপস্থিতি সরাসরি বাংলাদেশের ই-কমার্সের প্রসারকে সীমিত করছে।
পেপ্যাল না আসার কারণ
বাংলাদেশে পেপ্যাল না আসার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রা নীতিমালার সমস্যা। পেপ্যাল একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানি হওয়ায় এর পরিচালনার জন্য বিশেষ কিছু অনুমোদনের প্রয়োজন। দেশের মুদ্রানীতি, লেনদেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ, এবং বিদেশে অর্থ প্রেরণের জটিলতাগুলো পেপ্যালের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পেপ্যাল পরিচালনা করতে হলে বিদেশে অর্থ পাঠানোর অনুমতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার সহায়তা, এবং স্থানীয় বাজারের সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেখানে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছে এবং ই-কমার্স খাতও দ্রুত বিকাশমান, সেখানে পেপ্যালের মতো একটি সেবার অনুপস্থিতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। বিভিন্ন দেশীয় প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যদি সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং পেপ্যালের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করতে পারে, তাহলে তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও শক্তিশালী করবে।
বাংলাদেশে পেপ্যালের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের বাজারে পেপ্যাল চালু হলে তা শুধু ফ্রিল্যান্সার বা ই-কমার্স খাতের জন্যই নয়, বরং বিভিন্ন খাতের জন্যই উপকারী হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, পর্যটন, স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী করতে পেপ্যালের মতো একটি সেবার প্রয়োজন রয়েছে।
পেপ্যাল চালু হলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা আরও বৈশ্বিক হতে পারবে। আন্তর্জাতিক ক্রেতারা পেপ্যালকে তাদের প্রিয় পেমেন্ট মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, যা বাংলাদেশের ব্যবসাগুলোকে বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দেবে।